আমার মৃত্যু
সেদিন বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছিল। স্টেশনে ট্রেন থেকে যখন নামলাম তখন রাত এগারোটা। শেষ ট্রেন। অন্যসময় হলেও স্টেশনের বাইরে থেকে রিকশা পাওয়া যেত। কিন্তু সেদিন ওসব কিছু পেলাম না।
চাকরি করি আমাদের গ্ৰামেই সেচ দপ্তরের অফিসে। কয়েকদিনের জন্য কাজের দায়িত্বে শহরে গেছিলাম।কাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে সেদিন রাতে ফিরে আসি।
শেষ ট্রেন ধরতে হয়েছিল কারণ লাইনে গণ্ডগোল হয়েছিল।তাই বেশ কিছু ট্রেন বাতিল হয়েছিল।
আমি থাকি গ্ৰামে। তবু স্টেশন থেকে আমার গ্ৰাম দুই কিলোমিটারের কাছাকাছি। গ্ৰামের দিক হলে সন্ধ্যা সাতটাতেই যেন মাঝরাত মনে হয়। তবে এসব কথা সব গ্ৰামের জন্য নয়। এখন তো অনেক গ্ৰামেই বিদ্যুৎ এসে গেছে। তাদের কথা আলাদা। কিন্তু আমার গ্ৰামে আজও আসে নি বিদ্যুৎ। তাহলে আমার সেই সময়ের কথা ভেবে দেখুন পাঠকগণ।
আমি কিছু না ভেবে ভগবানের নাম নিয়ে এগিয়ে চললাম। আবার সেদিন বৃষ্টির রাত ছিল। তবে ঝমঝম করে হচ্ছিল না। ঝিরঝির করে হচ্ছিল। আর তারসাথে মাঝেমধ্যে দমকা ঝড় উঠছিল। আকাশের দিকে চেয়ে দেখছিলাম মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
স্টেশনের কাছটা একটু জমজমাট জায়গা। স্বাভাবিক ব্যাপার। আর স্টেশনের বাইরে থেকেই গ্ৰামের রাস্তা শুরু। বলা যায় ইটের রাস্তা। সেই রাস্তাই এঁকেবেঁকে চলে গেছে বিভিন্ন গ্ৰামে গ্ৰামে। তারমধ্যে আমাদের গ্ৰামটা দ্বিতীয়।
আমার কাছে আবার ছাতাও ছিল না সেদিন। বৃষ্টি তো সেরকম জোরে হচ্ছিল না তাই খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। অসুবিধা করছিল ঐ মাঝেমধ্যে যে দমকা ঝড় আসছিল সেটাই। তাও দশ পনেরো মিনিট পথ হেঁটে এসেছি।হঠাৎ দেখলাম আকাশ থেকে যেন একটা হিলহিলে সাপ এসে দূরে একটা তালগাছের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো একটা বিকট শব্দ করে। আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। বুঝলাম ওটা বাজ পড়লো। এইরকম দৃশ্য চোখের সামনে দেখে আমার বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো। মনে হচ্ছিল এত জোরে জোরে হৃদপিণ্ড চলছে ঠিক যেন আমার হাতে চলে আসবে এখনই। আসলে বাজ পড়ার আওয়াজ আমি অনেক শুনেছি কিন্তু সামনাসামনি কখনো দেখিনি। কাজেই সেদিন ঐ প্রথম দেখলাম অমন।
আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। রাস্তা একদম শুনশান। কে বেরোতে যাবে এমন ঝড়ের রাতে বাইরে যদি কোনো প্রয়োজন না থাকে। রাস্তার চারপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। শুধু ধানজমি আর ধানজমি দু চোখ যেদিকে যাবে সেদিকে দেখা যাবে। আসলে ঐ বাজ পড়ার আগে আমি প্রথম গ্ৰামটা পেরিয়ে এসেছি।এবার আরও কিছুটা পথ এই ভাবে যেতে হবে। তারপরে আমাদের গ্ৰাম শুরু। এই প্রথম গ্ৰাম আর আমাদের গ্ৰামের মাঝের অঞ্চলটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা। শুধু রাস্তা চলে গেছে দুপাশে ধানজমিকে সঙ্গী করে।
ভয় আমার বেড়ে গেল এই কারণেই কারণ, এখানে কোনো বাড়িঘর নেই যে একটু অন্তত মাথাটা বাঁচাবো। আর কোনো গাছের নিচে দাঁড়াবার সাহস পাই না। যদি গাছেতে বাজ পড়ে? আর এমন নির্জন জায়গায় এই রাত দুপুরে ভয় তো লাগবেই। তাও আবার দুর্যোগের রাত।
আরও বোধহয় পনেরো মিনিট পেরিয়ে এসেছি। এবার দেখতে পেলাম দূরে আমাদের গ্ৰামখানি। অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার দেখতে পেলাম। আসলে নিজের গ্ৰাম তো। যেকোনো অবস্থাতেই চিনতে পারব।বৃষ্টি কিন্তু তখনও কমে নি। ঐ হালকা ভাবে হয়েই যাচ্ছে সেই সাথে ঝড়ও চলছে মাঝেমধ্যেই। যদিও আর বাজ পড়ার শব্দ পাই নি শুনতে। ঐ প্রথমটাই যা পড়েছিল।
এখনও রাস্তার দুপাশে শুধু ধানজমি। গাছও আছে পথের ধারে ধারে তবে খুব কম কম। মানে আমি একরকম খোলা জায়গার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি।
হঠাৎ মাথায় একটা আঘাত পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার চোখের সামনে কত আলো।যেন দিন হয়ে গেছে। যেন আমার সামনে একশোটা সার্চলাইট কেউ জ্বালিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম আকাশে কী ভয়ঙ্কর একটা শব্দ হলো। মনে হল একসাথে এক লক্ষ দৈত্য চিৎকার করে উঠল। আমার শরীরে আর কোনো হুঁশ থাকলো না।আমি পড়ে গেলাম মাটিতে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। গ্ৰামে ঢোকার কিছু আগেই যমরাজ আমায় নিয়ে চলে গেলেন উপরে।
—- অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী
২৯/৩/২০২৪